বুধবার, সন্ধ্যা ৬:৩৯
৯ই এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৬শে চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ই শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি,

দেখার গল্প

তাহমিনা কোরাইশী
মিনার জীবনে দীপ এসেছে সেই প্রথম দেখার মুহূর্তে। তার আসাটা অন্য রকমের।হঠাৎই যেন উদয় তার। রাস্তার ওপাশ থেকে এপাশের একদল স্কুলছাত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এক অদ্ভুত ভঙ্গিমায়। দুহাত একসঙ্গে লাগিয়ে কাতর ভঙ্গিতে একটু শরীরটাকে বাঁকিয়ে দাঁড়ায়। ছাত্রীর দল মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাদেরও হাত উঁচিয়ে তাকে অভিবাদন জানায়। তাদের দৃষ্টি সেই যুবককে আকৃষ্ট করে। যুবকের দৃষ্টি মিনার মধ্যে এক শিহরণ জাগায়। এ যেন সেই প্রাগৈতিহাসিক প্রেম। পুরোনো দিনের নায়ক-নায়িকার প্রথম দেখার সেই মুগ্ধতার মোহ আবেশ।
কাতরওয়ালার আবির্ভার ছাত্রীদলের এখন মুখ্য আলোচনার বিষয়। এতগুলো মেয়ের মধ্যে মিনাকেই দীপের পছন্দ আর মিনারও তথৈবচ। প্রথম দেখাতেই এমন কঠিন দৃঢ় ভালোবাসা ভাবা যায়! মিনার মনে একটাই দ্বন্দ্ব কাজ করছে তা হলো ছেলেটা কোন ধর্মের! প্রথম পরিচয় হলো নমস্কারের মধ্য দিয়ে। মিনা ভাবছে, মুসলিম হলে সোনায় সোহাগা। আর অন্য ধর্মের হলেও সে মেনে নেবে। যদিও সমাজচ্যুত হতে হবে তবু তাকে নিয়েই থাকবে সারা জীবন। এমনই এক অঙ্গীকার তার নিজের মধ্যে। যদিও কৈশোরের প্রেম সবে ক্লাস এইটে পড়ে মিনা। প্রথম দেখার সেই প্রেম মনের মধ্যে গভীর এক অনুভূতির জন্ম দেয়। কী এক অদ্ভূত আকর্ষণ, কেমন একটা ঘোর কাটে না। সাঁতার না জেনে জলে ঝাঁপ দেওয়ার মধ্যে যদিও বীরত্ব নেই তবু রোমাঞ্চ আছে। এতটুকু জীবনে দেখা অনেকের সঙ্গেই হয়েছে কিন্তু এমনভাবে অন্তরের দুয়ার খুলে দেয়নি তো কেউ। মুহুর্মুহু ঝংকার ব্যথিত করে, কথারা বিণুনি গাঁথে। চারদিকে একই অবয়বে হ্যালোসিনেশনের ঘোর কাটে না মিনার।
চন্দ্রপ্রভায় স্নাত হয়ে ভাবে কেবল তাকেই। হঠাৎ সামনে আসা মূর্তিমান সুদর্শন সেই ছেলেটা খুব অল্প সময়েই মিনার মন জয় করে নেয়। সূর্যের প্রখর তাপে যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন নেই বলে বিনা দ্বিধায় এগিয়ে চলে মিনা।
অনেকের অনেক কথার সামনাসামনি হতে হয়েছে মিনাকে তবু সে অবিচল অটল তার সিদ্ধান্তে। দিন গড়িয়ে যায় শান্তিনগর- নয়াপল্টনের গলিপথে একটু দেখা বা চিঠি আদান-প্রদানে। সে তো একালের প্রেম নয়। উন্নত প্রযুক্তির জীবন থেকে বহুদূর ওরা। সামান্য একটা টেলিফোনেরও আকাল ছিল, আর দশ নম্বর মহা বিপদসংকেত মাথায় নিয়ে পথ চলতে হতো। এরই মধ্যে ভালোবাসা নিজের পথ নিজেই তৈরি করে নেয়। সময় চলে বাধাহীনভাবে।
দেখতে দেখতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের শেষ বর্ষের ছাত্র। ছাত্ররাজনীতিতে মুখ্য ভূমিকায় সে। দল বেঁধে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য মেলাঘরে ট্রনিং শেষে পরিপূর্ণ যোদ্ধার বেশে। ঢাকায় সে সময় নয় মাস গেরিলা বাহিনী হিসেবে যুদ্ধ করেছে। ভুলে গেছে সবকিছু, কেবল মনে হয়েছে- দেশ বড় নাকি প্রেমিকা না প্রেম।  দেশের জন্য প্রেমের ব্যাপারে সবকিছুই নগণ্য হয়ে যায়। পাঁজরের ভাঁজে ভাঁজে চোরাগোপ্তা হামলা যে হয় না তা তো নয়। আশায় আশায় দিন গোনে। মনের সেই আশালতা দিন দিন বৃদ্ধি পায়। একদিন তার ভালোবাসা পাবেই পূর্ণতা সে আশায় দিনযাপন।
এদিকে মিনাদের সেই যাযাবর জীবনের শুরু। কোথাও ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই বলে ছুটে চলা জীবন। যদিও সম্ভাব্য মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে নিজেদের রক্ষা করতে পেরেছে মিনাদের পরিবার। যুদ্ধকালীন বিপর্যয়ের ক্ষত মুছে যেতে সময় লেগেছে অনেকদিন। জীবনের পিচ্ছিল সময়, আঁধার কালো রাত পেরিয়ে যায় ঠিকই অবশেষে। গ্রামের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে অবস্থানের সমাপ্তি ঘটায় মিনার পরিবার। সে তখন কলেজের ছাত্রী। বুকে আশা নিয়ে অপেক্ষায়, দীপ আসবেই বিজয়ের বেশে লাল সবুজের অবয়বে।
অবশেষে সামনে এসে দাঁড়ায় তার ভালোবাসা। কোন ভাষায় আজ বলবে কথা। ভাষা কি রূঢ় নাকি অহংকারী জানা নেই দীপের। প্রিয় স্বদেশের মাটিতে স্বাধীন জন্মভূমিতে তার প্রেমিকের সামনে কেন এতটা অসহায় আজ দীপ! অবশ্য এক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানো অসম্ভব তাই ভর দেওয়ার লাঠিকে আশ্রয় করে মিনার সামনে আজ দীপ। মিনার দৃষ্টি ঝাপসা চোখের জলে ভেসে যায়। দীপ মুখ খোলে- ‘কেঁদো না মিনা। বিশাল কিছু পেতে গেলে সামান্য কিছু তো বিসর্জন দিতেই হয়। দেশকে পেয়েছি তাই আজ তোমাকে মুক্তি দিতে চাই। তার অসহায় জীবনের সঙ্গী করে আর কষ্টে ফেলবে না দীপ মিনাকে।
মুহূর্তেই বদলে যায় দৃশ্যপট। দীপকে হারানোর ভয় নিয়ে বেঁচে ছিল মিনা এতটা সময়। সেই প্রথম প্রেম,  প্রথম দেখা, প্রথম ভালোবাসা, প্রথম চুম্বন, প্রথম অঙ্গীকার, প্রথম স্পর্শ- সবই আজ এই একটি মুহূর্তের একটি বাক্যে মুছে দিতে পারে!
যুদ্ধে আহত হয়ে একটি পা হারিয়েছে তাই বলে কি মানুষটাও বদলে যাবে! সব অঙ্গীকার মিথ্যা হয়ে যাবে! রক্ত মাংসের এই মানবীর ওপর ভর দিয়ে কি দাঁড়াতে পারে না! এভাবে কি সম্পর্ক অস্বীকার করা যায়! কত যে অভিমানী শব্দগুলো সোচ্চার হয়ে প্রতিবাদের ভাষায় দীপকে বোঝানোর চেষ্টা করে। মিনা আজ বড় বেশি অসহায়। তবু যথার্থই চেষ্টা করে চলে। ফিরে পেতে চায় তার লাল সবুজের অহংকারী দীপকে।
বলেছে- ‘প্রথম দেখার সেই দিনটি ছিল আমাদের দৃষ্টি বিনিময়ের দিন। কঠিন বাস্তবকে আমি মেনেই এতটা দিন পথ চলেছি। শুভ দৃষ্টি বদল হয়ে গেছে সেই দিনই। আমৃত্যু তোমাকে জড়িয়ে বাঁচতে চাই। এ সত্যকে মুছে দেওয়া সহজ নয়। ওদের বুকজুড়ে যুদ্ধ-আগুন দাউ দাউ। প্রেমের দহন চৈত্রের পোড়া মাঠ জল তৃষ্ণায় ত্রাহী ত্রাহী বলে হাহাকার করে। তবু এ দেহ-মন চায় না করুণার জল। নিজের আত্মসম্মানকে পুঁজি করে মুখ ফিরিয়ে হাঁটতে থাকে দীপ কোন সে গন্তব্যে! প্রথম প্রেম প্রথম দেখা প্রথম ভালোবাসা কী এক দুর্লভ অহংকারের মুহূর্ত ওদের পাঁজরে দহন আনে কেন! নিজেকে স্থির রাখা কঠিন। আনন্দ কি দীর্ঘ পরিক্রমায় সুবর্ণজয়ন্তীতে অতিক্রম করতে পারে না!
Facebook

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *